বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০০৯


দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আহমাদ রাসেলঃ

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি)। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের তীরবর্তী  পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান। বরিশাল-পটুয়াখালীুকুয়াকাটা মহাসড়কে ফাইটার বিমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত স্কোয়ারটি সহজেই সকলকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  অবস্থান নির্দেশ করে। এই স্কোয়ার থেকে ৫ কিঃ মিঃ পুর্বে দুমকি উপজেলা সদরে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত ও নয়নাভিরাম গ্রামীণ পরিবেশের ৭২ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের অন্যতম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। প্রথম দর্শনেই যে কেউ এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে। 

শুরুর কথাঃ  স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আলতাফ হোসেনের উদ্যেগে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় জনতা কলেজ নামে একটি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ। গোল পাতার ছাউনি দেয়া ঘরে শুরু হয় কলেজের কার্যক্রম। সাবেক মন্ত্রী এম. কেরামত আলী, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ আ.ফ.ম. মোশারেফ হোসাইন খান, তৎকালীন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবদুস শাকুর এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অধ্যাপক ড. ওয়াদুদ মিয়ার উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পটুয়াখালী কৃষি কলেজ নামে কৃষি বিষয়ে একটি আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষা প্রদানকারী কলেজে পরিনত করেন। এ কৃষি কলেজটি ১৯৭৯-৮০ শিক্ষবর্ষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের অধিভুক্ত হয়ে বেসরকারি কৃষি কলেজ হিসেবে আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে তৎকালীন সরকার কলেজটিকে জাতীয়করন করেন।

 

বিশ্ববিদ্যালয় হলো যেভাবেঃ  জাতীয়করনের পর কলেজটি দক্ষ কৃষিবিদ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছিল। যার ফলশ্রুতিতে ৯০ এর দশকে আপামর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর প্রানের দাবী হয়ে ওঠে ‘পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে’। ১৯৯৭ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন সরকার পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরনের ঘোষনা প্রদান করেন এবং ২০০০ সালের ৮ জুলাই  পটুয়াখালী কৃষি কলেজের অবকাঠামোতেই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয়। ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী এক সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বাস্তবরূপ লাভ করে। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর প্রথমে উপাচার্য নিয়োগ ও রিজেন্ট বোর্ড গঠনের মাধ্যমে একে একটি পরিপূর্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেন এবং কার্যকরী গতিশীলতা আনেন।  

 

বর্তমান অবস্থাঃ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এ পর্যন্ত সাফল্যের সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বর্তমানে তিন অনুষদে ১৩০০ ছাত্র-ছাত্রী, ৯২ জন শিক্ষক, ৪২ জন কর্মকর্তা সহ দুই শতাধিক কর্মচারী রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী পাশ করে দেশের কৃষি উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া গত ২০০৭ হতে পোস্ট গ্রাজুয়েট ও পিএইচডি ডিগ্রি চালু করায় উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।

 

বর্তমান অনুষদঃ  কেবলমাত্র কৃষি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে দেশ ও জাতির সময়োপযোগী চাহিদা পূরনে বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ। তাছাড়া বরিশাল ভেটেরিনারি কলেজকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। এর মাঝে আন্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অনুষদ থেকে বিবিএ, কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ থেকে সিএসই এবং কৃষি অনুষদ থেকে বিএসসি এজি ও ফিশারিজ ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। কৃষি অনুষদ থেকে পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অনুষদের অধীনে এমবিএ ডিগ্রী ও ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনিস্টিটিউট চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে নতুন অনুষদ হিসেবে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এছাড়াও নতুন অনুষদ খোলা হলেও নতুন করে কোন কোন একাডেমিক ভবন নির্মাান না হওয়ায় ক্লাস রুমের চরম সংকট রয়েছে।

 

মনোরম ক্যাম্পাস ৭২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল মনোরম ক্যাম্পাস। এর মধ্যে ৩৫ একরের উপর মুল ক্যাম্পাস আর এর পাশেই ৩৭ একর জমির উপর কৃষি গবেষণা খামার। মুল ক্যাম্পাসের একাডেমিক ভবনের সম্মুখে বৃক্ষশোভিত সুদীর্ঘ লেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। লেকের নীল জলরাশিতে নানা প্রজাতির মাছের বিচরণ সকলকে করে বিমোহিত। আর লেকটির দু’পাশে সারি-সারি মেহগনি, নারিকেলসহ নানা প্রজাতির বনজ, ফলজ ও ওষধি গাছের সমাহার যে কাউকে করবে আকৃষ্ট। ক্যাম্পাসের উত্তর-পশ্চিমাংশে অত্যাধুনিক ছাত্র ও ছাত্রী হল শোভা পাচ্ছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হেলথ কেয়ার সেন্টার। আর এর উল্টো দিকে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্রন্থাগার ভবন। একটি প্রশস্থ রাস্তা ক্যাম্পাসের উপর দিয়ে পুর্বের পীরতলা থেকে পশ্চিমের পটুয়াখালী-বাউফল মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। এ সড়কের দক্ষিণ দিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন আর এর দক্ষিণে রয়েছে ‘সৃজনী বিদ্যানিকেতন’ নামের প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকতা-কর্মচারিদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পায়। মুল ক্যাম্পাসের পুর্বদিকে পীরতলা বাজার পেরুলেই ৩৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত কৃষি গবেষণা খামার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে একটি আউট ক্যাম্পাস। বরিশালেব ভেটেনারি কলেজটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হওয়ায় এটি বর্হিক্যাম্পাস হিসেবে বিবেচিত।

 

অত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতিঅত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে খ্যাত আমেরিকার কোর্স ক্রেডিট সিস্টেম পদ্ধতি চালু রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেমিস্টার পদ্ধতির এ শিক্ষা ব্যবস্থায় কোর্স যথাসময়ে শেষ হয় বিধায় কোন সেশনজট থাকে না। ৮ টি সেমিষ্টারে শিক্ষাপর্ব শেষ হয়। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা যথা সময়ে শিক্ষা জীবন শেষ করে প্রবেশ করতে পারে কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবনে। এছাড়াও দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্ব প্রথম ২০০২ সালে আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে কৃষি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা চালু করা হয়। হাতে-কলমে শিক্ষা দানের জন্য এখানে রয়েছে ১৪ টি সমৃদ্ধ গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি। রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সম্বলিত একটি সুবৃহৎ কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য রয়েছে ৪ টি প্রদর্শনী খামার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ অর্থাৎ অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের জন্য ৪৫ দিনের ইন্টার্ণীশীপ বাধ্যতামুলক। স্থানীয় কৃষকদের সাথে হাতে-কলমে কাজ করাই এ ইন্টার্ণীশীপের প্রধান লক্ষ্য। কৃষকদের অভিজ্ঞতার সাথে ইন্টার্ণীদের লব্ধ জ্ঞানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটানোই ইন্টার্ণীশীপের প্রধান। এর ফলে স্থানীয় কৃষকরা মান্ধাতা আমলের কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তে তাদের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর বিভিন্ন জরিপ ভিত্তিক গবেষনার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই দক্ষিনাঞ্চলে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করেছে।

 

সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ঃ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের একমাত্র সম্পূর্ন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রয়েছে এখানে। ছাত্রদের জন্য শহীদ জিয়াউর রহমান হল ও এম. কেরামত আলী হল এবং ছাত্রীদের রয়েছে জন্য চাঁদ সুলতানা হল । এ তিনটি আবাসিক হলে প্রায় সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে। তবে বর্তমানে চরম আবাসন সংকট বিরাজ করছে।

সমৃদ্ধ লাইব্রেরিঃ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দু’তলা বিশিষ্ট লাইব্রেরি ভবনে ২০ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বই, ভলুম, সাময়িকী রয়েছে। এ লাইব্রেরিতে পিন পতন নিরবতায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কাঙ্খিত বই পড়ার সুযোগ পান। নির্ধারিত নিয়ম-কানুন মেনে বই-পুস্তক কয়েকদিনের জন্য ধার নেয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া লাইব্রেরি ভবনের সামনে পড়ন্ত বিকেলটা জমে ওঠে শিক্ষার্থীদের প্রাণের স্পন্ধনে। আড্ডার জন্য ক্যাম্পাসের এ স্থানটি আর একাডেমিক ভবনের সামনের লেকের পাড়, খেলার মাঠের বেঞ্চিগুলোতে বিকেলটায় জমে ওঠে প্রাণের জোয়ার। তবে টিএসসি ও ক্যাফেটরিয়া বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রানের দাবী।

 

সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ডিবেটিং সোসাইটি অব পিএসটিইউ, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, খেয়ালী, পাঠচক্র, কবিতা পরিষদ, সাইট (তথ্য প্রযুক্তি ক্লাব), বিজনেস স্টুডেন্টস ফোরাম নামে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে এখানে। এর মাঝে ডিবেটিং সোসাইটি অব পিএসটিইউ প্রতি মাসে বিতর্ক প্রতিযোগীতাসহ বছরে একবার অন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগীতার আয়োজন করে থাকে। এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালিয়ের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। পাঠচক্রের আয়োজনে মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাম্মাসিক দেয়াল পত্রিকা বের করা হয়। একাডেমিক ভবনের মুল ফটকে সাম্প্রতিক  দেয়াল পত্রিকাগুলো শোভা পচ্ছে যা ভবনটির সৌন্দর্য বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।

 

তবে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের অনেক সমস্যা থাকলেও সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে এই প্রতিষ্ঠানের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।